তালিকাভুক্ত কোম্পানির উপর বাজেটের যে প্রভাব পড়তে পারে

আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল। এতে নানা খাতে অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি আয়কর, করপোরেট কর, আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য সংযোজন করসহ রাজস্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব করেছেন। জাতীয় সংসদে এসব প্রস্তাব অনুমোদিত হলে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন খাতের কোম্পানিগুলোর ব্যবসা ও মুনাফায় নানা মাত্রায় প্রভাব পড়তে পারে।
তবে বাজেটের কোনো প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়। এগুলো নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। এর প্রেক্ষিতে কোনো কোনো প্রস্তাবে পরিবর্তনও আসতে পারে। সংসদে অনুমোদন সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হবে।

উল্লেখ, গত ৯ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত উপস্থাপন করেছেন।

ঘোষিত বাজেটের যেসব প্রস্তাবের প্রভাব তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর উপর পড়তে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলো-

কর্পোরেট কর হার হ্রাস

ঘোষিত বাজেটে পাঁচটি খাত ছাড়া বাকী সব খাতের কোম্পানির আয়করের (Corporate Tax) হার শর্তসাপেক্ষে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে এসব কোম্পানিকে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

যেসব কোম্পানি তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশের শতাংশের বেশি শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ইস্যু করেছে বা করবে, সেসব কোম্পানিই কেবল কর হ্রাসের এই সুবিধা পাবে। এছাড়া লেনদেনের ক্ষেত্রেও মানতে হবে নতুন এক শর্ত। এই শর্ত অনুসারে, কর হ্রাসের সুবিধা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সকল প্রকার প্রাপ্তি ও আয় অবশ্যই ব্যাংক স্থানান্তরের মাধ্যমে গৃহীত হতে হবে এবং বার্ষিক ১২ লাখ টাকার অতিরিক্ত ব্যয় ও বিনিয়োগ অবশ্যই ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। এই শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে বর্তমান হারেই (২২.৫০%) করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হবে।

কম শেয়ার ছাড়লে মিলবে না করছাড়

করপোরেট ট্যাক্স কমানোর ফলে কোম্পানিগুলোর নীট মুনাফা বাড়বে। তাতে বাড়বে কোম্পানিগুলোর লভ্যাংশ বিতরণের সক্ষমতা। এতে কোম্পানিগুলো চাইলে আগের চেয়ে বেশি হারে লভ্যাংশ দিতে পারবে। অন্যদিকে বাড়তি মুনাফার একটি অংশ কোম্পানিগুলোর ব্যবসার সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কাজে লাগানো যাবে। তাতে উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারীরাও লাভবান হবেন।

যেসব কোম্পানি তাদের পরিশোধিত মূলধনের ১০ শতাংশ বা তার কম শেয়ার প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) ইস্যু করেছে বা করবে, সেসব কোম্পানিকে ২২ দশমিক ৫০ শতাংশ হারেই কর পরিশোধ করতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের শর্ত পরিপালনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে গুণতে হবে আড়াই শতাংশ জরিমানা। তখন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কর হার বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ শতাংশ।

পাঁচ খাতে বহাল থাকছে একই করহার
ঘোষিত বাজেটে তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার কমানোর ঘোষণায় জায়গা পায়নি স্টক এক্সচেঞ্জের পাঁচ খাতের কোম্পানির। কোম্পানিগুলোকে বর্তমান হারেই করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক খাতের কোম্পানির করপোরেট ট্যাক্স আগামী বছরেও ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ থাকবে। টেলিকম খাতের মোবাইল কোম্পানির করহার ৪০ শতাংশ থাকবে আগামী বছরেও। আর খাদ্য খাতের সিগারেট প্রস্তুতকারী কোম্পানিকে কর দিতে ৪৫ শতাংশ হারে।

কমেছে রপ্তানিমুখী কোম্পানির করের হার
এতদিন রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প ১২ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স পরিশোধের বিশেষ সুবিধা পেয়ে এসেছে। আগামী বছর অন্যান্য খাতের রপ্তানিমুখী শিল্প এবং সেবা খাতও এই সুবিধা পাবে। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে বর্তমানের চেয়ে ৮ শতাংশ কম হারে কর দিতে হবে। অর্থাৎ ২০ শতাংশের পরিবর্তে ১২ শতাংশ হারে কর দিলেই চলবে এসব কোম্পানিকে।আর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যদি হয় ‘গ্রিন শিল্প’ তাহলে সেটি আরও ২ শতাংশ কর ছাড় পাবে। এসব কোম্পানিকে কর দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে।

বস্ত্রে বেড়েছে কর ছাড়ের মেয়াদ
শ্রমঘন বস্ত্র শিল্পে (Textile) বর্তমানে করপোরেট করের হার ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই সুবিধা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ঘোষিত বাজেটে তা ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

এছাড়া বস্ত্র খাতে কৃত্রিম আঁশ (man-made fiber) এবং অন্যান্য আঁশের সংমিশ্রণে তৈরি ইয়ার্ন এর ভ্যাটের পরিমাণ কেজি প্রতি ৬ টাকা থেকে কমিয়ে ৩ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ইস্পাত শিল্পে নমনীয়তা
নির্মাণ খাতে গতি ধরে রাখতে ইস্পাত শিল্পে দেওয়া হয়েছে কিছু সুবিধা। এমএস (Mild Steel) পণ্যে স্পেসেফিক ভ্যাটের পরিমাণ টন প্রতি ৫০০ টাকা থেকে কমিয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে।
বাজেটে আয়রন শিট বা স্টিলজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত এইচআর কয়েল এবং জিংক অ্যালয় জাতীয় কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে করহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

রেফ্রিজারেটর-ফ্রিজে মিশ্র প্রস্তাব
এতদিন ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটরের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর)অব্যাহতি সুবিধা ছিল।অর্থাৎ এ পর্যায়ে কোনো ভ্যাট দিতে হতো না। ঘোষিত বাজেটে এই অব্যাহতি তুলে দিয়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এসব পণ্যের ব্যয় বাড়বে। তবে কাঁচামাল কেনায় ও কমপ্রেসর উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার মেয়াদ বাড়ানোয় কিছুটা স্বস্তিও পাচ্ছে এই খাত।

মোটরসাইকেল শিল্পে সুরক্ষার ছায়া বেড়েছে
উচ্চ ক্ষমতার মোটরসাইকেলের বাজারে প্রতিযোগিতায় আরও সক্ষম করে তুলতে দেশের মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য সুরক্ষার ছাড়া বাড়ানো হয়েছে।

বর্তমানে ২৫০ সিসি পর্যন্ত মোটরসাইকেল আমদানিতে Four stroke এর ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ ও Two stroke এর ক্ষেত্রে ২৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপিত রয়েছে।কিন্তু ২৫০ সিসির ঊর্ধ্বের ইঞ্জিন ক্ষমতা সম্পন্ন মোটর সাইকেল আমদানিতে কোনো সম্পূরক শুল্ক আরোপিত নেই। এই সেগমেন্টে সুরক্ষা দিতে ২৫০ সিসির ঊর্ধ্বের ইঞ্জিন ক্ষমতা সম্পন্ন মোটর সাইকেল আমদানিতে Four stroke এর ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ১০০ শতাংশ ও Two stroke এর ক্ষেত্রে ২৫০ শতাংশ আরোপ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ক্যাবল শিল্পে ২ সুবিধা
স্থানীয় ক্যাবল শিল্পের বিকাশে বাজেটে ২ ধরনের সুবিধার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই শিল্পকে সুরক্ষা দিতে Winding wire of copper এর রেয়াতি আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ হতে বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

এই শিল্পের কাঁচামাল Bars & Rods of alloy steel আমদানির ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে ঘোষিত বাজেটে।

স্বাস্থ্য-পণ্যে ঝাঁকুনি
করোনাভাইরাস টেস্টিং কিট, বিশেষ ধরনের মাস্ক এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক ও PPE উৎপাদনে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, করোনাভাইরাস সনাক্তকরণে RT-PCR কিট প্রস্তুতকরণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বর্তমানে শূন্য শুল্ককর সুবিধা আছে। দেশে করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতির কারণ দেখিয়ে চলতি জুন মাস শেষে বিদ্যমান এই রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন