দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিৎ যথাসময়ে সব কাজ করা। সরকার কর্তৃক যেকোনো নির্দেশনা সঠিক ভাবে মেনে করলে কোনো ধরনের জটিলতা থাকে না।একজন নাগরিকের উচিৎ নিজে থেকে নাগরিকের সব দায়িত্ব পালন করা।
একজন নাগরিকের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার নিরিখে নির্ধারিত হয় তিনি প্রতিবছর কত টাকা কর দেবেন। বাংলাদেশ রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত ফর্মে নাগরিক কর্তৃক প্রদানকৃত নির্দিষ্ট অর্থ-বছরে (১ জুলাই থেকে পরের বছর ৩০ জুন) তার আয়ের সকল তথ্যাবলী যাচাই করে আয়কর কর্তৃপক্ষ এই আয়করের পরিমাণটি ঠিক করেন। ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রত্যেক টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) ধারীর জন্য আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক করেছে। এই হিসাবপত্রটি জমা না দিলে বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জরিমানাসহ নানান ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই নথিপত্র জমা করা উচিত। চলুন, সরকারকে নিজের আয়ের বিবরণী জানানোর এই পদ্ধতিটি সম্বন্ধে জেনে নেওয়া যাক।
কাদের জন্য আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া জরুরি
করযোগ্য আয়কারী
* যাদের আয় বছরে ৩ লক্ষ টাকার বেশি
* নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, এবং ৬৫ বছর থেকে শুরু করে তদুর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তি; যাদের আয় বছরে ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বেশি
* প্রতিবন্ধী; যাদের আয় বছরে ৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার বেশি
* গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা; যাদের আয় বছরে ৪ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকার বেশি
এছাড়াও যাদের জন্য রিটান দাখিল আবশ্যক
→ যারা ১২ অঙ্কের টিন সনদ গ্রহণ করেছেন
→ পূর্ববর্তী ৩ বছরের যেকোন বছরে যাদের আয় করযোগ্য হয়েছে কিংবা যাদের কর নির্ধারণ হয়েছে
→ যাদের নামে নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানির শেয়ার আছে
→ যারা কোনো ফার্মের অংশীদার
→ যে সকল সরকারি কর্মকর্তার বেতন বছরের যেকোনো সময় ১৬ হাজার টাকা বা তার বেশি
→ কোনো নির্বাহী বা ব্যবস্থাপনা পদের কর্মী
→ কর্ম থেকে অব্যাহতি পাওয়া বা আয় কমে যাওয়া অবস্থায় যারা করযোগ্য হয়েছেন
→ যারা কোনো ধরনের মোটর গাড়ির মালিকানা পেয়েছেন
→ ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণকারি ব্যবসায়ী
→ মূল্য সংযোজন কর আইনের অধীনে থাকা কোনো সংঘের সদস্য
→ চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, আইনজীবী, অ্যাকাউন্টেন্ট, স্থপতি, প্রকৌশলী,
→ সার্ভেয়ার কিংবা এ জাতীয় কোন কাজের পেশাজীবী হিসেবে কোন স্বীকৃত সংস্থায় নিবন্ধিত ব্যক্তিরা
→ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত আয়কর কর্মকর্তা
→ শিল্প বিষয়ক চেম্বার বা ব্যবসায়িক সংস্থার সদস্য ব্যাক্তিরা
→ সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী ব্যাক্তিরা
→ স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি, আধা সরকারি অথবা স্থানীয় সরকারের টেন্ডারে অংশগ্রহণকারি ব্যক্তিরা
→ কোম্পানির পরিচালনার পরিষদে নিযুক্ত ব্যক্তিরা
→ লাইসেন্স করা অস্ত্রের মালিকানা প্রাপ্ত ব্যক্তিরা
→ স্থান, মোটরযান, বাসস্থান বা অন্যান্য সম্পদ সরবরাহের মাধ্যমে শেয়ারড আর্থিক কার্যক্রম-এ অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা।
যাদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে না
→ যে অনিবাসিদের বাংলাদেশে স্থায়ী কোনো ভিত্তি নেই
→ জমি বিক্রি করা বা ক্রেডিট কার্ড নেওয়ার জন্য যাদেরকে ১২ অঙ্কের টিন করতে হয়েছে, অথচ কোনো করযোগ্য আয় নেই
আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা
প্রতি বছর কর দিবস ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই করদাতাকে তার আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করতে হয়। জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে এই কর দিবসের মধ্যে যে কোন সময় রিটার্ন দেওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই সময়ের ভেতর জমা করা সম্ভব নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে করদাতাকে রিটার্ন দাখিলের সময়সীমা বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট ফর্মে উপকর কমিশনার বরাবর উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে আবেদন করতে হবে।
আবেদন মঞ্জুর হলে বর্ধিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে। এখানে করদাতার ওপর কোনো জরিমানা আরোপ না হলেও বিলম্ব সুদ এবং অতিরিক্ত সরল সুদ আরোপিত হবে।এছাড়া, এ বছরের জন্য প্রথমবারের মতো যারা রিটার্ন জমা দিচ্ছেন, তারা ৩০ নভেম্বরের পরিবর্তে আগামী বছরের ৩০ জনু পর্যন্ত জমা দিতে পারবেন।
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
বেতনভুক্তদের ক্ষেত্রে
* নির্দিষ্ট অর্থ-বছরে করদাতার বেতন বিবরণী
* প্রতিবছরের আয়ের কোনো অংশ ব্যাংক সুদ থেকে এলে, ঐ ব্যাংক হিসাবের নথি বা ব্যাংক সার্টিফিকেট
* বিনিয়োগ ভাতা বা বীমা প্রকল্প থাকলে তার প্রমাণাস্বরূপ নথি
নিরাপত্তা জামানতের সুদের ক্ষেত্রে
* নির্দিষ্ট অর্থ-বছরে ক্রয়কৃত বন্ড বা ডিবেঞ্চারের অনুলিপি। বন্ড বা ডিবেঞ্চারটি ব্যাংক/কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রয় করে থাকলে, সেই ব্যাংক/প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে প্রত্যয়নপত্র
* সুদ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সুদ কেন্দ্রিক আয়ের জন্য সেই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রত্যয়ন পত্র
বাড়ি/জমি-সম্পত্তির মালিকদের ক্ষেত্রে
* এক্ষেত্রে বাড়ি ভাড়ার চুক্তিপত্র/ভাড়ার রশিদের অনুলিপি। এর সাথে প্রাপ্ত বাড়িভাড়া ব্যাংকে জমা রাখলে সেই ব্যাংক হিসাব বিবরণী
* পৌরসভা/সিটি কর্পোরেশন কর/ভূমি রাজস্ব প্রদানের রশিদের কপি
* বাড়ি ক্রয় বা নির্মাণের উদ্দেশ্যে ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করলে ঐ ঋণের সুদের বিপরীতে ব্যাংক হিসাব বিবরণী এবং ব্যাংক সনদপত্র
ব্যবসায়ী ও নির্দিষ্ট দক্ষতার পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে
* এক মালিকানা বা অংশীদারি ব্যবসার এবং নির্দিষ্ট পেশা থেকে লব্ধ আয়-ব্যয়ের বিবরণী
মূলধনী লাভ থেকে আয়ের ক্ষেত্রে
* করদাতার স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর অথবা বিক্রি হলে তার দলিলের অনুলিপি
* মূলধনী উৎসে আয়কর জমা হলে তার চালানের অনুলিপি
* পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানীর শেয়ার লেনদেন থেকে আয় করলে তার বিপরীতে প্রত্যয়নপত্র
অন্যান্য উৎসের আয়ের ক্ষেত্রে
* ব্যাংক/অন্য প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত নগদ টাকা থেকে লাভ গ্রহণ করলে তার ব্যাংক হিসাব এবং ডিভিডেন্ট ওয়ারেন্টের অনুলিপি বা সনদপত্র
* ব্যাংক/অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত সুদের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র ভাঙার সময় কিংবা সুদ প্রাপ্তির সময় নেওয়া সনদের অনুলিপি
* এছাড়া অন্য কোনো ধরনের উৎস থেকে আয় করলে ঐ উৎসের প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র
কর পরিশোধের প্রমাণ স্বরুপ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
* যারা ইতোমধ্যে কর দিয়েছেন, তাদের কর পরিশোধের বিপরীতে চালান কপি, পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, একাউন্ট-পে-চেক
* উপরোক্ত যেকোনো উৎস থেকে আয়ের ভিত্তিতে আয়কর প্রদান করা হলে কর আরোপকারী কর্তৃপক্ষের প্রত্যয়নপত্র
আয়কর রিটার্ন ফরম
দরকারি সব কাগজপত্র প্রস্তুত হয়ে গেলে এবার রিটার্ন ফরম পূরণের পালা। এনবিআর (ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভেনিউ) থেকে প্রতিবছরই এই ফর্মে নতুন কিছু পরিবর্তন আনা হয়। নতুন বা পুরাতন যে কোন রিটার্ন ফর্ম করদাতা তার নিকটস্থ আয়কর অফিস থেকে বিনামূল্যে সংগ্রহ করতে পারবেন।
এছাড়াও এনবিআর-এর ওয়েবসাইট থেকেও প্রয়োজনীয় ফর্মগুলো ডাউনলোড করা যাবে। করদাতার জন্য প্রযোজ্য ফর্মগুলো নির্ভুল ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সরাবরাহের মাধ্যমে যথাযথভাবে পূরণ করতে হবে। এ সময় কোনো বিষয় নিয়ে কোন রকম সন্দেহ বা বিড়ম্বনা সৃষ্টি হলে ব্যক্তিগত আইনজীবীর পরামর্শ নেওয়া উত্তম।
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পদ্ধতি
এ পদ্ধতিতে হিসাব জমা করার জন্য প্রথমে করদাতাকে এনবিআর-এর ওয়েবসাইটের ই-ট্যাক্স রিটার্ন পেজে প্রবেশ করতে হবে। এই পৃষ্ঠার মাধ্যমে করদাতা ইরিটার্ন সাইটে নিবন্ধন করতে পারবেন। এর জন্য সোজা চলে যেতে হবে “ই-রিটার্ন” অপশনে। পরের পৃষ্ঠায় নিচে লেখা “রেজিষ্ট্রেশন” বাটনটিতে ক্লিক করতে হবে।
এবার এখানে ইংরেজিতে করদাতার ১২ অঙ্কের টিন সংখ্যা ও মোবাইল নাম্বার দিতে হবে। অতঃপর ক্যাপচা বসানো, মোবাইল নাম্বার যাচাইয়ের জন্য ওটিপি দেওয়া এবং পাসওয়ার্ড ঠিক করার মাধ্যমে নিবন্ধনের কাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয়ে যাবে।
এবার আবার ই-ট্যাক্স রিটার্ন সাইটে যেয়ে ১২ অঙ্কের টিন সংখ্যা ও পাসওয়ার্ড দিয়ে “সাইন ইন” করতে হবে। এরপরেই করদাতা ইরিটার্ন সাইটে তার নিজস্ব ইউজার ড্যাশবোর্ডে প্রবেশ করতে পারবেন। এখন বাম পাশের তালিকা থেকে ক্লিক করতে হবে “রিটার্ন সাবমিশন”-এ।
আর এর ফলেই তিনি পৌছে যাবেন অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার মূল অংশে। এখানে আয়ের উৎস ও হিসাব সহ প্রয়োজনীয় সকল তথ্য সঠিক ভাবে সরবরাহ করতে হবে। প্রতি পৃষ্ঠাতেই তথ্য দেওয়ার পর নিচের “সেভ এ্যান্ড কন্টিনিউ” বাটনে ক্লিক করে পরের পৃষ্ঠায় যেতে হবে।
সবগুলো পৃষ্ঠায় তথ্য দেওয়া শেষ হলে চূড়ান্ত ভাবে আয়কর রিটার্নের সারসংক্ষেপ দেখানো হবে। এখানে তথ্য সব ভালো ভাবে যাচাই করার পর “ভিউ রিটার্ন” বাটনে ক্লিক করলে তা করদাতাকে তার রিটার্ন ফর্মটি সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা অবস্থায় দেখাবে। এখান থেকে সবকিছু আরও একবার নিরীক্ষা করে নিয়ে নিচের দিকে “ভেরিফিকেশন”-এ টিক মার্ক দিয়ে দিতে হবে। সবশেষে “সাবমিট রিটার্ন” বাটনে ক্লিক করলেই সফলভাবে দাখিল হয়ে যাবে আয়কর রিটার্ন।
জমাকৃত আয়কর রিটার্নের একটি কপি ডাউনলোডের পর প্রিন্ট করে পরবর্তী প্রয়োজনের জন্য সংরক্ষণ করতে হবে।
কোথায় আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হয়
কর প্রদানকারিদের শ্রেণীর ওপর ভিত্তি করে রির্টান দাখিলের পৃথক পৃথক আয়কর সার্কেল নির্দিষ্ট করা থাকে। যেমন- ঢাকা জেলায় অবস্থিত যে সকল বেসামরিক সরকারি ও পেনশনভুক্ত কর্মকর্তার নাম এ, বি এবং সি অক্ষরগুলো দিয়ে শুরু হয়েছে, তাদেরকে ঢাকা কর সার্কেল-৭১ ও কর অঞ্চল-৪-এ রিটার্ন জমা দিতে হয়।
নতুন করদাতারা তাদের নাম, চাকুরিস্থল অথবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা যে কর অঞ্চলের অধীনে পড়েছে সেখানে গিয়ে ১২ অঙ্কের টিন সংখ্যা উল্লেখ করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। এছাড়া প্রয়োজনে তারা নিকটস্থ আয়কর অফিস কিংবা কর পরামর্শ কেন্দ্র থেকে সার্কেল অফিস সম্বন্ধে জেনে নিতে পারবেন।
দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণের টাকা নাগরিকদের আয়কর থেকে আসে। সরকারি কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীর বেতন-ভাতার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের একটা বেশ বড় অংশই নির্ভর করে এই আয়করের ওপর। তাছাড়া সরকারি যাবতীয় পরিষেবাগুলোকে সুষ্ঠুভাবে নাগরিকদের কাছে পৌছে দিতে আয়করের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তাই নিজেদের স্বার্থেই আয়কর নিশ্চিত করতে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া উচিত।